সৎপথে অর্জন করার পর তাকে সদুদ্দেশ্যে ব্যয় করা হলে ধন সম্পত্তি সার্থক হয়ে থাকে, কিন্তু তার অপব্যবহার করা হলে সেই ধন সম্পত্তিই মানুষের জন্য ঘাতক হয়ে ওঠে।
ধন উপার্জনের মুখ্য উদ্দেশ্য হল জীবন যাপনের জন্য দৈনিক এবং মূল প্রয়োজনগুলিকে পূর্ণ করা। এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে প্রত্যেকটি মানুষেরই অর্থের প্রয়োজন আছে। আহার , বস্ত্র এবং বাসস্থানের জন্য অর্থের প্রয়োজন হয়।
অতিথি সৎকার, পরিবারের ভরণ পোষণ, সন্তানদের শিক্ষা, বিবাহ, চিকিৎসা, দুর্ঘটনা, অকাল, আপদ বিপদ ইত্যাদির জন্য অল্প বিস্তর অর্থ প্রত্যেক পরিবারের কাছে সঞ্চিত থাকা দরকার।
বেশীর ভাগ মানুষই মিথ্যা ঠাট, লোক দেখানো সম্ভ্রম, ফ্যাশন এবং বদভ্যাসের জন্য খরচ করাকেই ধনেরউপযোগিতা মনে করে। এ কাজ তাদের জন্যও যেমন ক্ষতি কারক একই সাথে সমাজের জন্যও ক্ষতিকারক সাব্যস্ত হয়ে থাকে।
Make Yourself Self Reliant In Bengali Language
নিজের কাছে সেটুকু অর্থ থাকাই ভাল, যার সাহায্যে দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর পর যা কিছু অবশিষ্ট থাকবে, তাকে অসময়ে খরচ করা কিংবা কোন কল্যাণমূলক কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে।
কৃত্রিম প্রয়োজন এমনই দুৰ্গুণ, যার বশবর্তী হয়ে মানুষ নিজেই নিজের পায়ে কুড়াল মারে। ধন উপার্জন করা সহজ, কিন্তু তা খরচ করা খুব কঠিন। সম্পন্ন অথবা নির্ধন যাই হোক না কেন অপব্যয় কারোরই করা উচিত নয়।
ধন বিবেকসম্মত ভাবে উপার্জন করা উচিত এবং বিচারসম্মত উপায়ে খরচ করা উচিত। ভবিষ্যতের জন্য ধন সঞ্চয়ের দৃষ্টিতে আজকের মিতব্যয়িতাই হল গুরুত্বপূর্ণ।
যে ব্যক্তি নিজের প্রয়োজনকে সীমিত রাখতে পারে তাকেই মিতব্যয়ী বলা চলে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, পরিবার ও ব্যবস্থাপনার জন্য অর্থের প্রয়োজন হয়, কিন্তু নিজের প্রয়োজনকে সীমিত রাখা এবং নিজের সামর্থের দ্বারা তাকে পূর্ণ করা বড়ই সুখের বিষয়। নিজের প্রয়োজনগুলিকে কাট ছাঁট করা এবং মিতব্যয়ী হবার জন্য বুদ্ধি খরচ করতে হয়।
অসত্য ও সত্যের মধ্যে, রাত ও দিনের মধ্যে যেমন পার্থক্য থাকে, তেমনই কার্পণ্য এবং মিতব্যয়িতার মধ্যেও একই প্রকার পার্থক্য থাকে। ধনের উপযোগিতা অর্থাৎ যার দ্বারা জীবনের প্রয়োজন পূর্তি হতে পারে, এবং সাধারণ জীবনে মানুষ প্রতিষ্ঠা ও সম্মানের সাথে এক সামাজিক প্রাণী রূপে বসবাস করতে সক্ষম হতে পারে। কিন্তু কৃপণরা কেবল ধন সঞ্চয় করাকেই তার উপযোগিতা বলে মনে করে।
প্রকৃত মিতব্যয়ী ব্যক্তিরা সামাজিক কার্যের জন্য মুক্তহস্তে দান করার বিষয়ে কোন কার্পণ্য করে না। কষ্ট সহ্য করতে হলেও ঋণ করা থেকে সব সময় দূরে থাকা উচিত। এই বিষয়ে একটি প্রচলিত লোকোক্তি হল, ‘ঋণের বোঝা নিয়ে সকালে ঘুম থেকে ওঠার বদলে রাতে না খেয়ে শোওয়া ভাল।’
ঋণ মানুষের জীবনে ‘ঘুণ ধরার মত তার সুখ, শান্তি এবং শক্তির সর্বনাশ করে দেয়। তোমরাও মিতব্যয়ী হতে চেষ্টা করো, এতেই তোমাদের কল্যাণ হবে। নিজের আয়ের বাইরে খরচ কোর না।
আজকের এক একটি পয়সার সময় আগামী কালের জন্য অনন্ত সুখকর প্রমাণিত হতে পারে। নিজের এবং ঘর পরিবার ও আশ্রিতদের সুরক্ষার কাজে ধন সংগ্রহ করার বিষয়ে কেউই কোথাও নিষেধ করেনি।
কিন্তু প্রত্যেকটি বস্তু কিনবার সময়, প্রত্যেকটি নতুন প্রয়োজন বাড়ানোর আগে, নিজের কাছে প্রশ্ন করো যে, সেগুলি কি তোমার একান্তই প্রয়োজন? তাদের ছাড়া কি তোমার কাজ চলবে না? ও সবের জন্য খরচ করা কি একান্তই আবশ্যক?
পাশ্চাত্য সভ্যতাকে যারা নকল করে এবং নিজের দেশের চাহিদাকে যারা বোঝার চেষ্টা করে না, তারাও এক প্রকার দেশদ্রোহী বলে গণ্য হয়ে থাকে।
যদি তুমি নিজের দেশের স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত রাখতে চাও, তাহলে তোমাকে সাধারণ মানুষদের জীবন স্তরকে উন্নত করে তুলতে হবে। তুমি স্বয়ং মিতব্যয়ী হও এবং নিজের আশেপাশের দীন দরিদ্র ব্যক্তিদের অগ্রসর হওয়ার কাজে, তাদের উন্নতিকল্পে সহায়ক হও।
তোমার সহায়তায় যদি কোন অসহায় প্রতিভাশালীর জীবন পরিবর্তিত হয়, তাহলে তোমার সেই আত্ম সন্তুষ্টি অন্যান্য অনেক বড় ধরণের সম্মান ও অভিনন্দনের চাইতেও অনেক বেশী সুখদায়ক হবে।
অপব্যয়, ঋণ, বৃথা চাঞ্চল্য এবং অনর্থক ব্যয় সাপেক্ষ প্রচলনের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করবে। তুমি যদি নিজের ঘরে এতটা সংযম পালন করতে সক্ষম হও তাহলে বাস্তবে নিজের দেশকে তুমি মহাত্মা গান্ধী এবং টলস্টয়ের দেশ রূপে গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।
দেশকে স্বর্গ কিংবা নরক করে তোলা তোমাদেরই হাতে। তোমরা নিজেদের মনকে সংযত করো, নিজেদের প্রয়োজনকে সীমিত করো, এটুকুই যথেষ্ট হবে।
Saphalya arjaner gurutbapurnata
মানুষের জীবনে সর্বোপরি এবং সর্বসমর্থ শক্তিটির নাম হল — আত্মবল। এই আত্মবলের অভাবে যাবতীয় জাগতিক সামর্থ্য এবং উপলব্ধিগুলি কেবল বোঝার মত হয়ে যায়৷ ধন সম্পদ, বুদ্ধি, স্বাস্থ্য ইত্যাদিকে নিয়ন্ত্রণ করে তাদের সঠিক পথে পরিচালিত করার উপযুক্ত একটি কেন্দ্ৰীয় সামর্থ্যও থাকা চাই। এই সামর্থ্যের নামই আত্মবল।
মানুষ শুধু একটি শরীর মাত্রই নয়, তার মধ্যে এক পরম তেজস্বী আত্মাও বিদ্যমান রয়েছে। আমাদের সকলেরজেনে রাখা উচিত যে, মানুষ কেবল ধন, বুদ্ধি এবং স্বাস্থ্যের ভৌতিক বলের সাহায্যেই সাংসারিক সুখ, সম্পদ, সমৃদ্ধ এবং প্রগতি লাভ করতে পারে না, এর জন্য আত্মবলেরও যথেষ্ট প্রয়োজন থাকে।
আত্মার অভাবে যেমন শরীরের কোন মূল্যই থাকে না, তেমনই আত্মবলের অভাবে শারীরিক শক্তিও কেবল ছেলেখেলার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
আত্মবল সেই ক্ষমতার নাম, যার যতখানি অংশ মানুষের কাছে থাকবে, সে তার বিবেককে ততটাই সচেতন রাখতে সক্ষম হবে। বিবেকই হল সেই সত্তা, যা মানুষের ধনসম্পত্তি, বুদ্ধি, স্বাস্থ্য ইত্যাদি জাগতিক শক্তিকে নিয়ন্ত্রিত করে সৎপথে পরিচালিত করে এবং সদুদ্দেশ্যে সদ্ প্রয়োজনে প্রবৃত্ত করে।
জীবনের সকল ক্ষেত্রে সফল হবার জন্য দ্বিতীয় গুণটি হল আত্মবিশ্বাসী হওয়া। পৃথিবীর প্রতিটি অগ্রণী ব্যক্তিই আত্মবিশ্বাসী হয়ে থাকেন। আত্মবিশ্বাসীরা প্রশংসনীয় কর্মবীর হন। কোন রকম হীন মনোবৃত্তি, দীনতা অথবা নিকৃষ্টতা তাদের ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারে না।
নিত্য নতুন উৎসাহে তারা নিজের কর্মপথে অগ্রসর হন, নিত্য নতুন প্রচেষ্টা ও প্রয়োগ করে থাকেন, প্রতিকূলতা এবং প্রতিরোধের সাথে সাহসীর মত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয় লাভ করেন। মানুষের জীবনেও নানা ধরণের সমস্যা এবং অপ্রিয় পরিস্থিতি লেগেই থাকে।
এই ঝাড় ঝঞ্ঝায় কঠোর পাহাড়ের মত নিজের পথে অটল থাকার জন্য যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসের প্রয়োজন। আত্মবিশ্বাস মানুষের চেহারায় ও ব্যক্তিত্বে এমন আকর্ষক হয়ে ফুটে ওঠে, যার দ্বারা অপর ব্যক্তিও তাদের আপন হয়ে যায়, অচেনা অজানা মানুষও সঙ্গীসাথীর মত সহযোগিতা করে ।
মানুষ যতই বিদ্বান, গুণবান এবং শক্তিশালী হোক না কেন, তার মধ্যে যদি আত্মবিশ্বাসের অভাব থাকে, তাহলে সে বিদ্বান হয়েও মুর্খের সমতুল্য জীবন যাপন করবে। শক্তিশালী হওয়া সত্বেও সকলের কাছে কাপুরুষ রূপে প্রতীত হবে। আত্মবিশ্বাস মানুষের শক্তিকে সংগঠিত করে, তাদের এক দিশায় নিযুক্ত করে থাকে। শারীরিক ও মানসিক শক্তিগুলি আত্মবিশ্বাসীদের সঙ্কেতের মাধ্যমেই পরিচালিত হয়।
কাপুরুষ একবার জন্মায় এবং বার বার মরে, কিন্তু আত্মবিশ্বাসীরা একবারই জন্ম নেয় আর একবারই মরে।
নিজের উপর বিশ্বাস করা, নিজের শক্তির উপর বিশ্বাস রাখা এমনই দিব্যগুণ যা প্রত্যেকটি কাজ করার যোগ্য সাহস, বিচার এবং যোগ্যতা উৎপন্ন করে থাকে।
অপরের উপর নির্ভরশীল হলে নিজের শক্তিহ্রাস হয় এবং নিজের ইচ্ছাপূর্তির বিষয়ে নানবিধ বিঘ্ন উৎপন্ন হয়ে থাকে। তুমি কোন সমস্যা সমাধানের জন্য অপরের সাহায্য নিতে পারো, কিন্তু কখনই তাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে না।
সুনিশ্চিত সাফল্যের জন্য আত্মনির্ভরতা এক অত্যাবশ্যক গুণ। তোমাদের নিজস্ব সমস্যাগুলি নিজেরাই সমাধান করার চেষ্টা কোরো। তুমি যদি অন্যের উপর নির্ভর করে থাক, যদি ভাবো, অন্য কেউ তোমার দুঃখ কষ্ট দূর করে দেবে, তা কেবল ভ্রান্ত ধারণা ছাড়া কিছুই নয়। তোমার যাবতীয় সমস্যা সমাধানের চাবী তোমার নিজের হাতেই আছে।
পৃথিবীতে সাফল্য লাভের আকাঙ্খার সাথে সাথে নিজের যোগ্যতাকেও বাড়িয়ে তুলতে শুরু করতে। যদি আত্মনির্ভর হতে পারা যায়, যেমনটি হতে চাও ঠিক তারই অনুরূপ যদি নিজের যোগ্যতা তৈরী করতে প্রবৃত্ত হও, তাহলে বিধাতাকে বাধ্য হতে হবে তোমার ইচ্ছানুসার তোমার ভাগ্য লিপি লিখতে।
যারা আত্মনির্ভরশীল, আত্মবিশ্বাসী এবং আত্মনির্ণায়ক, যাদের কাছে নিজস্ব বিবেক বুদ্ধি আছে, তাদেরই জীবন সাফল্য ও সন্তুষ্টিতে ভরা থাকে। আত্মনির্ভরশীলদের কোন কাজেই অপরের মুখাপেক্ষী হতে হয় না। তারা নিজেদের পথের বাধা নিজের হাতে সরিয়ে দিয়ে এগিয়ে যেতে সমর্থ হয়।
তুমি যদি জীবনে সাফল্য, উন্নতি, সম্পন্নতা এবং সমৃদ্ধি চাও তাহলে আত্মনির্ভরশীল হও। নিজের জীবনের পথ নিজের হাতে প্রশস্ত করে তোল এবং নিজেই সেই পথে এগিয়ে চল। পরাবলম্বী অথবা পরাশ্রিত থেকে তুমি এই পৃথিবীতে কিছুই করতে পারবে না। আশ্রিত নয় বরং আশ্রয় হয়ে ওঠাতেই মানুষের শোভা বর্দ্ধিত হতে পারে।